প্রস্তরযুগের সর্বপ্রাচীন পর্যায়টিই হল পুরাপ্রস্তর বা প্রাচীন প্রস্তর সংস্কৃতি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, 'সংস্কৃতি শব্দটি এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 'সংস্কৃতি' শব্দটির মাধ্যমে একটি বিশেষ সময়ে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার উপকরণ সমূহকে বোঝায়। প্রস্তর যুগে মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালী তাদের ব্যবহৃ হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি, খাদ্যদ্রব্য প্রভৃতি ছিল বিশেষ ধরণের। একই ধরণের জীবনযাত্রা প্রণালী ইত্যাদির সাক্ষ্য বহ করে এমন নিদর্শন যে সব এলাকা পাওয়া গেছে সে সব এলাকাকে ঐ যুগের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা হোক, বিশ্বপ্রেক্ষাপটে পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির সূচনাকাল খ্রীষ্ট জন্মের প্রায় ৪০ লক্ষ পূর্ববর্তী বলে ধরা হয়। কি ভারতে এখনও পর্যন্ত এই যুগের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে সমস্ত নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তার ভিত্তিতে অনুমান করা যা এ দেশে এই যুগটির সূত্রপাত মোটামুটিভাবে ৪ লক্ষ বছর পূর্বে হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এ দেশে পুরাপ্রস্তর পর্বে প্রাচীনত্ব নির্ধারণ করতে গিয়ে গবেষকদের যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ফলে বিভিন্ন ঐতিহাসি পুরাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক এমনকি ভাষাবিজ্ঞানীরাও এই পর্বের সূচনাকাল নিয়ে নানা মতবাদ পেশ করেছেন। এ মতভেদের অন্যতম প্রধান কারণ হল পুরাপ্রস্তর যুগের নির্ণীত তারিখের সংখ্যা।
প্রাথমিকভাবে মহারাষ্ট্রের বোরি থেকে প্রাপ্ত তারিখই ভারতে প্রস্তরযুগের সূচনাকাল বলে ধরা হত। এ তারিখ ছিল প্রায় ১০ লক্ষ বছর আগেকার। কিন্তু পরবর্তী গবেষণায় এই তারিখ ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। আধুনিককালে পুরাপ্রস্তর ক্ষেত্রগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন যে তারিখ পাওয়া গেছে তা আজ থেকে প্রায় ৪ লক্ষ বা পূর্বেকার। এ প্রসঙ্গে গোদাবরী উপত্যকায় নেভাসা এবং কৃষ্ণা উপত্যকার ইয়েদুরওয়াড়ির নাম উল্লেখ পড় অধ্যাপক দিলীপকুমার চক্রবর্তী অবশ্য ১৯৮০'র দশকে হিমাচল প্রদেশের শিবালিক পাহাড় ও লাদাখের সিন্ধু মধ উপত্যকায় প্রাপ্ত প্রস্তরায়ুধের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, ভারতবর্ষে পুরাপ্রস্তর যুগের সূত্রপাত পা মিলিয়ন বছর বা তার কাছাকাছি সময় হওয়ার সম্ভাবনা ও দাবি দুই-ই জোরালো হয়ে উঠেছে এবং দিদ আবিষ্কারগুলি একথাও জানান দিচ্ছে যে দক্ষিণ এশীয় ভূখণ্ডের কোন অঞ্চল মানুষের ক্রমবিবর্তনের ইতিগ্রা মধ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
হাতিয়ারের গঠন, ধরণ, বিবর্তনের ভিত্তিতে আবার পুরাপ্রস্তর যুগকে তিনটি ভাগ করা হয়, যথা- অঞ্চ পুরাপ্রস্তর যুগ, মধ্য পুরাপ্রস্তর যুগ, উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অষ্টাদশ শতকের শেষ ও উদির মধ্য শতকের সূচনায় ডেনমার্কের দুই পণ্ডিত পি.এফ সুহম ও ক্রিশ্চিয়ান থমসন তিনভাবে বিভক্ত যুগের ধারা অন প্রথম তুলে ধরেছিলেন, প্রস্তরযুগের পরবর্তী ক্রমান্বয়ে সেখানে স্থান পেয়েছিল ব্রোঞ্জ ও লৌহ
পরবর্তীকালপর্বে শুধুমাত্র প্রস্তরযুগের মধ্যেই পরিবর্তনের ধারা তথা লক্ষণগুলিকে সনাক্ত করার প্রচেষ্টা গবেষকমহলে জোরদার হয়ে ওঠে। ১৮৬৩ সালে জন লুবক প্রস্তর যুগকেই দুটি অংশে ভাগ করেছিলেন পুরাপ্রস্তর ও নব্যপ্রস্তর পর্ব। এর কয়েক বছর পর এডুয়ার্ড লারটেট সমগ্র পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতিকেই তিনটি ভাগে ভাগ করার পরামর্শ দেন নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতি। বলাবাহুল্য এই ধরণের বিভাজনের মূল ভিত্তি ছিল পরিবর্তিত প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রস্তরায়ুধের নির্মাণ ও গঠন প্রকৃতির পরিবর্তন। যাই হোক, ভারতে নিম্ন পুরাপ্রস্তর পর্বের কালসীমা হিসেবে ২০০০০০০ বছর থেকে ১০০০০০ বছর, মধ্য পুরাপ্রস্তর পর্বের কালসীমা হিসেবে ১০০০০০ থেকে ৪০০০০ বছর এবং উচ্চ পুরাপ্রস্তর পর্বের কালসীমা ৪০০০০ বছর থেকে ১০০০০ বছরের মধ্যে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তবে অঞ্চল ও ক্ষেত্র বিশেষে উপরোক্ত কালানুক্রমের মধ্যে তারতম্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
অধ্যাপক দিলীপকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন যে, নিম্ন পুরাপ্রস্তর পর্বের নির্ণীত তারিখের সংখ্যা এখনও কম। বর্তমানের ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে নিম্ন পুরাপ্রস্তর পর্বের যে তারিখগুলি পাওয়া গেছে তা কম সংখ্যক হলেও যথেষ্ট প্রাচীন, যেমন -পশ্চিমের রাজস্থানের দিদওয়ানা অঞ্চল বেশি; ১৫০০০০ বছর পর্যন্ত। ৩৯০০০০ বছর এবং
- সৌরাষ্ট্রের জুনাগড় ও উমরেথি থেকে পাওয়া তারিখ ১৯০০০০ বছর, ৬৯০০০ বছর
- মহারাষ্ট্রের গোদাবরী উপত্যকার নেভাসা ৪০০০০০ বছর বা কম বেশি।
- কর্ণাটকের কৃষ্ণা উপত্যকায় ইয়েদুরওয়াড়ি থেকে ৪০০০০০ বছর বা কম বেশি।
- কর্ণাটকের হুনসি ও বৈচাবল উপত্যকা ২৯০০০০ বছর, ৩৫০০০০ বছর ও ১৭৪০০০ বছর।
পূর্ব মধ্যপ্রদেশের শোন উপত্যকা একেবারে শেষ পর্যায়। ১০৩০০০ কম বেশি ১৯৮০০ বছর নিম্ন পুরাপ্রস্তর পর্বের একবারে শেষ পর্যায়। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের তারিখগুলি বিক্ষিপ্ত। তবুও এগুলি থেকে এই পর্যায়ের প্রাচীনতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্য পুরাপ্রস্তর পর্বের নিরূপিত তারিখগুলি সংখ্যায় বেশি। রেডিওকার্বণ সমীক্ষা পদ্ধতিতে যে তারিখগুলি করা হয়েছে তা ৪০০০০ থেকে ১০০০০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং সবকটিই মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র থেকে সংগৃহীত হয়েছে। অন্য পদ্ধতিতে নির্ণীত কয়েকটি তারিখ থেকে মনে করা যেতে পারে যে, এই পর্যায়ের সূত্রপাত ৪০০০০ বছরের অনেক আগেই হয়েছে। যেমন পশ্চিম রাজস্থানে দিদওয়ানাতেই এই পর্যায় ১৬৩০০০ কম বেশি ২১০০০ বছর। সৌরাষ্ট্রের জেতপুরে ৫৬০০০ বছরের বেশি। মধ্যপ্রদেশের শোন উপত্যকায় এই পর্যায়ের তারিখ ১০০,০০০ থেকে ২৬,০০০ বছর।
পুরাপ্রস্তর পর্বের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রাচীন তারিখ ৪৫০০০ ৪০০০০ বছর। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের পেশোয়ারের উত্তর-পূর্বে সাংঘাও গুহা থেকে এই পর্যায়ের একটি তারিখ ৪২৫০০ বছর। অন্যদিকে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী ও মান্দাসোর জেলার দুটি অঞ্চল থেকে পাওয়া তারিখ ৩১,০০০ বছর। কিছু তারিখ অবশ্য ২০,০০০ বছরের কম। শোন উপত্যকায় উত্তরপ্রদেশে বেলান উপত্যকায় এই তারিখ ২৬,০০০ বছর হতে পারে। অন্ধ্রের কুর্নুল অঞ্চলের ২০০০০ বছরের কম বেশি।